সাহিত্য ও জীবন বিভাগ, যমুনাপ্রবাহ.কম:
১৬৬৪ সালে ক্রিসমাস ঈভের প্রাক্কালে লন্ডন শহরে এক ইংরেজ মহিলা তার নিজ গৃহে মৃত্যুবরণ করলেন। পরীক্ষা করে দেখা গেল গুডওমেন ফিলিপ্স নামের এ মহিলাটি ব্যুবুনিক প্লেগে মারা গেছেন।’ ১৬৬৪ সালে প্লেগের শুরু এভাবেই। পরবর্তীতে মাত্র কিছু লোকেরই প্রাণহানি হল প্লেগে। কিন্তু ১৬৬৫ সালের এপ্রিলের দিকে রোগটি মহামারী আকার ধারণ করল। গ্রীষ্ম ঋতু পরুদস্তুর শুরু হতে না হতেই মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেলে দু’সহস্রাধিক এবং জুলাই নাগাদ মৃত্যুর এ মিছিল সংখ্যায় গিয়ে দাঁড়াল ৭,৪৯৬। রোগটি শুরু হওয়ার পর থেকে ১৮ মাস পর শুধু লন্ডন শহরেই মৃতের সংখ্যা অবিশ্বাস রকম বেড়ে দাঁড়াল ১ লাখে যা সংখ্যায় লন্ডন শহরের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ। ২৩ বছরের যুবক আইজ্যাক নিউটন তখন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলেন। আচানক একদিন তার শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি হওয়ায় অবিলম্বে তিনি নির্দেশিত হলেন ক্যামব্রিজ ছেড়ে যেতে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আদেশের সঙ্গে সঙ্গে নিউটন চলে গেলেন তার পরিবারের মালিকানাধীন খামারবাড়ি লিঙ্কনশায়ারে। সেখানে নিউটনের বিস্তর অবসর কিন্তু অবসরে অযথা সময় নষ্ট করা কিংবা সময়ের স্রোতের অনুকূলে গা ভাসিয়ে দেয়ার মতো মানুষ তিনি না। বিশাল বাড়িটির দক্ষিণমুখী জানালার গরাদের ফাঁক গলে সূর্যের আলো এসে খেলা করে ঘরের মেঝেতে। দীর্ঘ সময় ধরে এক দৃষ্টিতে নিউটন তাকিয়ে থাকেন আলোর দিকে। ভাবেন, বাধা পেলে আলো কি বেঁকে যায়? কিংবা আলোর প্রকৃত রংটাই বা কী?
মাধ্যাকার্ষণ নিয়ে আস্ত একটি তত্ত্বের ভ্রূণ, নিউটনের মস্তিষ্কে সৃষ্টি হয়েছিল এ কোয়ারেন্টিনে বসেই। ঠিক যেদিন গাছ থেকে আপেলটি মাটিতে পড়ল ঠিক সেদিনই নিউটনের চিন্তার গর্ভে মাধ্যাকার্ষণ নামক বিখ্যাত সেই তত্ত্বটির বীজ অঙ্কুরোদগম হয়েছিল। সে সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হতে পারি এর কয়েক বছর পর নিউটন তার এক বন্ধুকে যে চিঠিটা লেখেন তা থেকে। নিউটন তার বন্ধুকে লেখেন-
কোয়ারেন্টিনের দিনগুলোতে আমার কাছে অনেক সময় ছিল। তাই যেসব প্রশ্নের উত্তর তখন পর্যন্তও পাইনি সেগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করি। মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে যে চিন্তাভাবনাগুলো মাথায় খেলা করছিল সেগুলোই আবার ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম।
আইজ্যাক নিউটন ১৬৬৯:
মাধ্যাকর্ষণ বিষয়ে পরিপূর্ণ তত্ত্বটি নিউটন দিয়েছিলেন আরও ২০ বছর পর। উইলিয়াম শেক্সপিয়রও কোয়ারেন্টিনের অবসরে লিখেছিলেন অনেক কায়জয়ী নাটক ও কবিতা। শেক্সপিয়র সম্পর্কে পড়াশোনা করে যতটুকু ধারণা করা যায় তাতে বলা যায় শেক্সপিয়রকে সম্ভবত সমগ্র সাহিত্যকর্মের তিন ভাগের একভাগ শুধু কোয়ারেন্টিনে বসেই লিখতে হয়েছিল। যদিও কিছুদিন আগে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’ শুধু ‘কিং লিয়ারের’ কথাই লিখেছে।
পত্রিকাটি আমাদের জানাচ্ছে যে শেক্সপিয়র কোয়ারেন্টিনে বসে ‘কিং লিয়ার’ নাটকটি লিখেছিলেন। কিন্তু আমার ধারণা এক-তৃতীয়াংশ রচনা শেক্সপিয়রকে কোয়ারেন্টিনে বসেই লিখতে হয়েছিল। আমার বক্তব্যের পেছনের কারণগুলো বলছি।
১৩০০ সালের পর থেকে মাঝে মাঝেই সে দেশের মানুষ প্লেগে আক্রান্ত হতো এবং এর ফলে বহু মানুষের মৃত্যু হতো। একরকমভাবে বলা যায় শেক্সপিয়রের জন্মও হয়েছিল প্লেগ মহামারী চলাকালীন। শেক্সপিয়রের জন্ম ১৫৬৪ সালের ২৪ এপ্রিল। শেক্সপিয়রের জন্মের সঠিক তারিখ জানা যায় না। মনে করা হয় তিনি ২২ কিংবা ২৩ এপ্রিল জন্মেছিলেন। কারণ ২৪ এপ্রিল যে তাকে স্ট্রাটফোর্টের একটি চার্চে ব্যাপটাইজ করা হয়েছিল সে প্রমাণ আছে। অন্যদিকে ১৫৬৩ সাল থেকে ১৫৬৫ সাল পর্যন্ত মাত্র দু’বছরে ইংল্যান্ডজুড়ে ৮০ হাজার লোক শুধু প্লেগেই মারা গিয়েছিল।
মৃত্যুবরণ করেছিলেন শেক্সপিয়রের অগুনতি বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও সুহৃদ। এ ছাড়া এডমন্ড নামে ২৭ বছরের শেক্সপিয়রের আপন সহোদর ও তিন সহোদরা, যথাক্রমে- জোয়ানা ও মার্গারেট- এ দু’জন একেবারে শিশু অবস্থায় এবং অ্যান নামের ৭ বছরের আরেকটি বোন মারা যায় প্লেগে। তবে শেক্সপিয়র সম্ভবত বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন তার পুত্র হ্যামনেট মারা যাওয়ার সময়। দু’কন্যা, এক পুত্র ও স্ত্রী অ্যান হিতওয়েকে নিয়ে শেক্সপিয়রের সংসার।
দু’কন্যা- সুজানা হল ও জুডিথ কুইনি, একটি মাত্র পুত্র হ্যামনেট। ১৫৯৬ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে পুত্র হ্যামনেটও মারা যায় প্লেগে। পরবর্তীকালে ‘হ্যামলেট’ নাটকটি শেক্সপিয়র তার পুত্র হ্যামনেটের নাম অনুসারেই যে রেখেছিলেন সেটা সহজেই অনুমেয়।
প্লেগে যে শুধু শেক্সপিয়রের আপন চার ভাইবোন ও এক পুত্রই মৃত্যুবরণ করেছিলেন তা কিন্তু নয়। শেক্সপিয়র মারা যান ১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল। ১৬১৭ সালের মে মাসে মারা যান তার ৬ মাসের এক নাতি, নাম শেক্সপিয়র কুইনি এবং আরও দুই নাতি যথাক্রমে ১৯ বছরের রিচার্ড কুইনিং এবং ২০ বছরের থমাস কুইনি। উপরোক্ত মৃত্যুর পরিসংখ্যান দেখে অনেকেই হয়তো চমকে উঠছেন! ভাবছেন তাহলে শেক্সপিয়র বেঁচে গেলেন কীভাবে?
চিকিতসা বিজ্ঞানের ইতিহাস আমাদের জানাচ্ছে- হাড়কাঁপানো শীতের দেশের মানুষ হয়েও শিশুকাল থেকেই শেক্সপিয়র নাকি ছিলেন ভয়ানক রকম শীতকাতুরে। সে জন্য সব সময় তিনি ফায়ার প্লেসের আশপাশে থাকতেন। আর রাতে ঘুমাতেনও সেই অগ্নিচুল্লির পাশে। সে জন্য ফ্লাইয়া নামক যে কীটগুলো প্লেগ ছড়ায় সেগুলো শেক্সপিয়রের ধারে কাছেও ভিড়তে পারেনি।
উপরোক্ত হিসাব থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যদি একটি পরিবারেই শুধু ৮ জন সদস্য মারা যায় প্লেগে তাহলে সে আমলে প্লেগ কতটা ভয়াবহ ছিল। ভালোমতো ইতিহাস পর্যালোচনা করে সহজেই এটা প্রতিভাত হয় যে, সে সময়কার ইংরেজ জনজীবন ছিল বেশ প্লেগময়। ছ’মাস থেকে কখনও কখনও দু’আড়াই বছর পর্যন্ত থাকতে হতো হোম কোয়ারেন্টিনে। তবে শেক্সপিয়রের সাহিত্যকর্ম সৃষ্টির সময়টাতে প্লেগ সম্ভবত তিনবার বেশ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল সেটা- ১৫৯৩, ১৬০৩ ও ১৬০৮ সালে।
কারণ ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় এ সালগুলোতে লন্ডনের থিয়েটারগুলো বন্ধসহ সবকিছু লকডাউন করে দেয়া হয়েছিল। ১৫৯২ সালের মাঝামাঝি প্লেগের কবলে পড়ে লন্ডনে প্রথম বারো মাসেই মারা যায় প্রায় এগারো হাজার লোক। এর ফলে ১৫৯৪-এ মে মাসের লন্ডনের থিয়েটারগুলোতে লাগাতার অভিনয় সম্ভব হয়নি। ১৫৯৩ সালে শেক্সপিয়র প্রকাশ করেন তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডনিস’, আর তার পরের বছর ‘দ্য রেপ অফ লুক্রিস’। এ দুটো লেখাই সম্ভবত শেক্সপিয়র গৃহে অন্তরীণ অবস্থায় লিখেছিলেন- প্রথমটা হালকা চালে বলা প্রেমকাহিনী, দ্বিতীয়টা চড়া সুরের নিষ্ঠুর গল্প।
দুটো গল্পের সূত্রই শেক্সপিয়র ধার করেছিলেন প্রাতঃস্মরণীয় রোমান কবি ওভিদের (৪৩ খ্রিস্টপূর্ব-১৮ খ্রিস্টাব্দ) ‘মেটামর্ফোসেস’ থেকে। দুটো বই-ই উতসর্গ করা হয়েছে বছর কুড়ি বয়সের তরুণ আর্ল অফ সাউথহ্যাম্পটন হেনরি রোসলিকে। ‘ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডনিস’-এর আখ্যাপত্রে তার নাম ছাপা হয়নি। স্ট্র্যাটফোর্ডের অধিবাসী রিচার্ড ফিল্ড লন্ডনে ছাপাখানা খুলেছিলেন। শেক্সপিয়রের প্রথম কয়েকটি বই ছাপা হয়েছিল রিচার্ড ফিল্ডের সহায়তায়।
শেক্সপিয়র সম্ভবত ‘ওথেলো’ নাটকটিও লিখেছিলেন গৃহবন্দি থাকাকালীন। কারণ ওথেলো প্রকাশিত হয় ১৬০৪ সালে। শেক্সপিয়রের শেষের দিককার একটি লেখা ‘চেম্বারলিন’ও সম্ভবত অনিচ্ছা নির্বাসনে বসেই লিখেছিলেন তিনি। প্লেগ মহামারীর আতঙ্ক শেক্সপিয়রকে সম্ভবত ভীষণভাবে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। এ জন্যই হয়ত প্লেগ নিয়ে তিনি কোনো সাহিত্য রচনা করার সাহস করেননি। তবে তিনি ইতালিয়ান লেখক বোক্কাচ্চ জিওভানি (১৩১৩-১৩৭৫) লিখিত ‘দি দেকামেরন’ পড়ে প্রাণীত হয়ে ‘চেম্বারলিন’, ‘দ্য মার্চেন্ট অফ ভেনিশ’ এবং ‘অলওয়েল দ্যাট অ্যান্ডস্ ওয়েল’ নাটকগুলো লিখেছিলেন। বোক্কাচ্চ জিওভানির ‘দ্য দেকামেরন’ লেখাটিও প্লেগকে কেন্দ্র করেই। ১৩৪৮ সালে ফ্লোরেন্স নগরীতে প্লেগ মহামারী আকারে দেখা দেয়। ‘দ্য দেকামেরনে’ মহামারী প্লেগ আক্রান্ত শহরের বাস্তব চিত্র এঁকেছেন বোক্কাচ্চ।
শুধু শেক্সপিয়র কিংবা নিউটনই নন কোয়ারেন্টিন কিংবা এ অনিচ্ছা নির্বাসন কিছু সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে অনেকটা আশীর্বাদ বয়ে এনেছে। যেমন ইংরেজ সাহিত্যের প্রথম দিককার লেখক জেফ্ররি চসার তার অবিস্মরণীয় লেখা ‘দ্য ক্যন্টারবারি টেলস্’ও গৃহে অন্তরীণ অবস্থায় লিখেছেন। যদিও চসার সেই সময়টায় ভীষণভাবে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
কিন্তু কুষ্ঠ রোগ কিংবা প্লেগ কোনোটাই তাকে রুখতে পারেননি। আরেক ইংরেজ লেখিকা মেরি শেলীও ভয়ানক শ্বাসকষ্ট ও শরীরে কৃত্তিম শ্বাস-প্রশ্বাসের যন্ত্র লাগিয়ে লিখেছিলেন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেস্টাইন’। অন্যদিকে সিলভিয়া প্লাথ লিখেছিলেন ‘দ্য বেল জার’ ও লেখক উইলিয়াম কেনেডি লিখেছিলেন ‘আয়রণউইড’। আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনের ৭৫ শতাংশ লোক যখন সিফিলিসে আক্রান্ত ঠিক সেই সময়টায় ইংরেজি সাহিত্যের উচ্চমার্গীয় লেখক জেমস্ জয়েস লিখেছিলেন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘ইউলিসিস’।
২০১২ সালে আমেরিকার হার্বার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জন জে রস নামে প্রসিদ্ধ এক চিকিতসক একটি বই লেখেন, নাম- ‘শেক্সপিয়র’স ট্রেমোর অ্যান্ড অরওয়েল’স ক্ফ। বাংলা করলে বইটির নামের মানে দাঁড়ায় ‘শেক্সপিয়রের আঁকাবাঁকা লেখা এবং অরওয়েলের কাশি’।
রস নামের এ চিকিতসক ভদ্রলোক শেক্সপিয়রের হাতের লেখা পরীক্ষা করে তার বইটিতে লিখেছেন- শেক্সপিয়র নাকি সিফিলিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কাঁপা কাঁপা হাতের আঁকাবাঁকা লেখাই নাকি এর যথেষ্ট প্রমাণ। ডক্টর রস আমাদের আরও জানাচ্ছেন শেক্সপিয়র যতটা না সিফিলিসে ভুগেছিলেন তার চেয়ে বেশি ভুগেছিলেন এর চিকিতসাপত্র করতে গিয়ে। সত্যি সত্যি যদি শেক্সপিয়র সিফিলিসে ভুগে থাকেন তাহলে রস ঠিকই বলেছেন। কারণ সিফিলিস নামক ভয়াবহ রোগটি থেকে বাঁচতে সে যুগে মানুষ কী কী না করত। সিফিলিস নামের এ মহামারীটি দাপিয়ে বেড়িয়েছে প্রায় ছ’শ বছর।
কে ভোগেননি সেই সময় এ রোগটিতে। ফ্রান্সের রাজা অষ্টম চার্লস, ক্রিস্টোফার কলম্বাস, হার্নেন কার্তেজ, লিও তয়েস্তয়, নিতসে, বদলেয়ার, মোপাঁসা, জার্মান কবি হাইনরিক হাইনে, মুসোলিনি, হিটলার, লেলিন, বিখ্যাত ডাচ চিত্রকর র্যামব্রেন্ড সহ আরও কত কত নাম। গি দ্য মোপাঁসা নাকি সিফিলিসের যন্ত্রণা নিয়েই লিখতেন। যখন মাথার যন্ত্রণা কিছুতেই অগ্রাহ্য করতে পারতেন না তখন সে সময়কার প্রত্যক্ষ ফলপ্রদ ওষুধ হিসেবে কানের কাছে পাঁচটা জোঁক লাগিয়ে কলম নিয়ে বসতেন। মাঝে মাঝে মাথার যন্ত্রণায় চোখে কিছুই দেখতে পেতেন না। কিন্তু সিফিলিসের অল্প আক্রমণ নাকি লেখায় প্রেরণা দেয়। সিফিলিসের জীবাণু যখন ধীরে ধীরে মস্তিষ্কে উঠে আসে তখন জীবাণুর সুড়সুড়িতে মস্তিষ্ক নাকি উত্তেজিত হয়। কিছু সময়ের জন্য আশ্চর্য ক্ষমতা পায় কলম। যেমন পেয়েছিলেন হাইনরিথ হাইনে, বোদলেয়ার, নিতসে। আর পঞ্চাশ বছর পর জন্মালে মোপাঁসার রোগ ধরা পড়ত। সেই সঙ্গে চিকিতসাও নিশ্চয়ই হতো।
তবে আমার ধারণা প্রকৃতি যতটা নেয় কোনো না কোনোভাবে আবার সে ক্ষতি পুষিয়ে দেয়। এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মহামারীর মধ্যেই রচিত হয়েছিল বিখ্যাত কিছু সাহিত্য। ফ্রান্সে যখন ভয়াবহ কলেরা চলছে ঠিক তখন বরেণ্য ফরাসি লেখক আলবেয়ার ক্যামু লিখলেন সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘দ্য প্লেগ’।
স্পেনে ভয়াবহ ইনকুইজেশন কৃতকীর্ত লেখক মিগুয়েন সার্ভেন্টিস (১৫৪৭-১৬১৬) কে অনুপ্রাণিত করেছিল তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দনকিহতে’ লিখতে। আমেরিকায় ত্রিশের দশকে নিদারুণ মহামন্দার প্রেক্ষাপটে আমরা পেয়েছিলাম দুটো বিখ্যাত উপন্যাস। প্রথমটি জন স্টাইনবেকের ‘দ্য গ্রেপস অব র্যাথ’ আর দ্বিতীয়টি স্কট ফিটজেরান্ডের ‘দ্য গ্রেট গ্যটসবি’।
সেসব সম্মানিত পাঠক-পাঠিকা কষ্টসহিষ্ণু হয়ে কিছুটা সময় নিয়ে এ লেখাটি পাঠ করলেন তাদের মজার ও তথ্যসমৃদ্ধ একটি ঘটনা বলে লেখাটা শেষ করব। আমার ধারণা বিষয়টি অবশ্যই আপনাদের বিবিধ চিন্তার খোরাক জোগাবে। ‘হেনরী দি এইটথ্’ বোধহয় শেক্সপিয়রের শেষ নাটক। এ নাটকের যখন অভিনয় চলছিল তখন হঠাত আগুন লেগে গ্লোব থিয়েটার ভস্মীভূত হয়ে যায়। এটা ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দের কথা। এরপর থেকে শেক্সপিয়র অধিকাংশ সময় স্ট্র্যাটফোর্ডেই কাটাতেন। এপ্রিলে সে সময়ের নাট্যকার বেন জনসন ও কবি মাইকেল ড্রেটন শেক্সপিয়রের অতিথি হয়েছিলেন স্ট্র্যাটফোর্ডে।
রাতের ভোজ বাড়িতে শেষ করে পানভোজনের জন্য শেক্সপিয়র বন্ধুদের নিয়ে হানা দিয়েছিলেন কিছু দূরের এক শুঁড়িখানায়। পুরনো দিনের গল্প করতে করতে তাদের ফিরতে রাত হয়েছিল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লেগে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন শেক্সপিয়র। সম্ভবত আক্রান্ত হয়েছিলেন নিউমোনিয়ায়। মাত্র বায়ান্ন বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। শেক্সপিয়রের জন্মদিন ও মৃত্যু দিন বোধহয় একই। ২৩ এপ্রিল, ১৬১৬ তিনি পরলোকগমন করেন। অনেকের মতে বায়ান্ন বছর আগে ঠিক ২৩ এপ্রিলই তার জন্ম হয়েছিল।
৩১ মার্চ মঙ্গলবার বাংলাদেশের যমুনা টেলিভিশন ডক্টর রাবার্ট প্যারি নামে একজন আমেরিকান চিকিতসক ও বিজ্ঞানীর সাক্ষাতকার প্রচার করে। ডক্টর প্যারি আমাদের জানাচ্ছেন যে করোনা নামের এ ভাইরাসটির অস্তিত্ব নাকি এ পৃথিবীতে বহুকাল আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। মৃদু উপস্থিতির কারণে ভাইরাসটি কিছুটা ভিন্ন রূপ ধরে ছিল এতদিন। অল্প স্বল্প উপসর্গের কারণে এটার উপস্থিতি ছিল এতদিন অজানা।
সময়ের সঙ্গে ভাইরাসটি এতদিন খাপ খাওয়াতে পারেনি মানবদেহে। এটি বাদুড়সহ অন্যান্য প্রাণীর দেহে বেঁচে ছিল দীর্ঘসময় ধরে। কিন্তু বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষকে কাবু করার পর্যাপ্ত শক্তি অর্জন করেছে বর্তমানের এ করোনা।
ডক্টর রবার্ট প্যারির মতে করোনার অস্তিত্ব এ পৃথিবীতে যদি বহুকাল ধরে বিদ্যমান হয়। অন্যদিকে শেক্সপিয়রও মৃত্যুবরণ করেছিলেন নিউমোনিয়ায়। তাহলে শেক্সপিয়রও কি আক্রান্ত হয়েছিলেন করোনায়?